Magic Lanthon

               

মইনুল ইসলাম ও আসাদ লাবলু

প্রকাশিত ২৬ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

হানি’র ওমর

রোমিও-জুলিয়েটের মাঝখানেও দখলদারের দেয়াল

মইনুল ইসলাম ও আসাদ লাবলু



বার্লিনের দেয়াল এখন আর নেই। নিখাদ বস্তুতে গড়া ওই দেয়াল দুই জার্মানির মানুষের মধ্যে কতোটা দূরত্ব তৈরির মানসে গড়ে উঠেছিলো, তা মোটামুটি বিদিত। বর্তমানে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী পশ্চিমতীরের দেয়ালকে অনেকেই বার্লিনের দেয়ালের সঙ্গে তুলনা করে। বৈষম্যের প্রতীক হিসেবে মিল থাকলেও এই দুই দেয়ালের মধ্যে পার্থক্য হলো, বার্লিনের দেয়ালটি পূর্ব কিংবা পশ্চিম জার্মানি¾কোনো অংশেরই বাসিন্দাদের মনোবাসনায় নির্মাণ হয়নি। ওটা উভয় অংশের দখলদারদের দখলকৃত অঞ্চলের সীমানা নির্দেশক আইল-বিশেষ। সে আইলের পশ্চিম পাশে চলতো ধনতন্ত্র আর পূর্ব পাশে চলতো সমাজতন্ত্রের চাষ। যদিও কোনো অংশেই মাটির চাওয়াকে আমলে নেয়নি দখলদাররা।

অন্যদিকে, পশ্চিমতীরের দেয়াল কিংবা আইলটি ফিলিস্তিনিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্মাণ হলেও ইসরাইলের জন্য ঠিক তা নয়। ওটা ইসরাইলিরা নিজেদের মাটির উর্বরতার স্বার্থে বেঁধেছে। এখন তারা সেখানে চাষবাস করছে নিজেদের মতো করে। বললে ভুল হবে না, তাতে পৃথিবী নামক চরার বড়ো বড়ো ভূস্বামীদের সহযোগিতাও আছে। আর আইলের আরেক পাশের জমিকে অর্থাৎ ফিলিস্তিনি অংশকে ক্রমে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পতিতের দিকে। কিন্তু পতিত জমিতেও প্রকৃতির নিয়মে নানারকমের উদ্ভিদের জন্ম-মৃত্যু, বেড়ে ওঠা, দুর্যোগ কিংবা তার প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে। এ রকমই একটা জমির আনাচেকানাচের দৃশ্য সেলুলয়েডে তুলে ধরেছেন পরিচালক হানি আবু আসাদ।

তবে ওমর (২০১৩) নামের এই চলচ্চিত্রে আইলের ওপাশের সম্পৃক্ততাকেও তিনি এড়িয়ে যাননি। এই লেখায় হানি আবু আসাদের ক্যামেরার অবলোকনকে বাস্তবের অবলোকনের সঙ্গে খানিকটা তুলনার চেষ্টা থাকবে। তবে প্রথমেই এ কথা স্বীকার করে নিচ্ছি, ইসরাইল-ফিলিস্তিন নিয়ে মূলধারার তথ্য সরবরাহকারীরা যা উৎপাদন করে, সেখান থেকে সত্যিকারের বাস্তবতা ছেঁকে বের করা দুরূহ ব্যাপারই বটে। ফলে এ বক্তব্য পাঠক নিজেও পরিমার্জন, পরিশোধন করতে পারেন।

২.

মূল আলোচনা শুরুর আগে তিনটি বিষয়ের ফ্ল্যাশব্যাক দরকার। ফিলিস্তিন-ইসরাইল ভূখণ্ডের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্রের অতীত নিয়ে দু-চার কথা এবং এক-দুই লাইনে হানি আবু আসাদের চলচ্চিত্রনির্মাতা হয়ে ওঠার গল্প।

ঐতিহাসিক ওমর মসজিদ ও মুসলমানদের প্রথম কাবা আল-আকসা; ইহুদিদের ধর্মীয় পুণ্যস্থান ওয়েলিং ওয়াল (Wailing wall); খ্রিস্টান ধর্মের পবিত্র স্থান যিশুখ্রিস্টের ক্রুশ বহনকারী ভিয়া দোলোরোজা বা দুঃখময় পথ¾একেশ্বরবাদী প্রাধান্যশীল এই তিন ধর্মের পুণ্যস্থানগুলোর অবস্থান জেরুজালেম শহরে। উৎপত্তিগতভাবেই জেরুজালেম শব্দের অর্থ পবিত্র। পবিত্র এ নগরী শান্তির নগরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে শুরু থেকেই। কিন্তু নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে কালক্রমে সেখানে চলতে থাকে এক ধর্মের ওপর অন্য ধর্মের আধিপত্য রক্ষার লড়াই।

ইহুদি ধর্মের গোড়াপত্তন ঘটে হাজার তিনেক বছর আগে। বয়সের দিক থেকে এই ধর্মকে পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মগুলোর কাতারে ফেলা যায় অনায়াসেই। মধ্যপ্রাচ্য হলো এই ইহুদিদের আদি নিবাস। তবে তারা এখন নিজেদের আদি বাসভূমি হিসেবে যে জায়গা চিহ্নিত করে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। হযরত মুসা আ. বা মোজেস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই সম্প্রদায়ের সবচেয়ে সুন্দর সময় গেছে খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছর আগে সম্রাট দাউদ বা ডেভিডের (হযরত দাউদ আ.) সময়। দাবি করা হয়, বর্তমান লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও মিশরের বড়ো অংশই ছিলো তখনকার কিংডম অব ইসরাইলের অংশ। ডেভিডের ছেলে সলোমন বা সোলায়মান-এর (হযরত সোলায়মান আ.) সময়ও তাদের অবস্থা ভালো ছিলো। কিন্তু তার মৃত্যুর পর এ জাতি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ সময় আসিরিয়ানরা ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে ঢুকে পড়ে ও দখল করে নেয়। এর পর বিভিন্ন সময় ব্যাবিলিয়ান, পার্সিয়ান, হেলেনেস্টিক, রোমান, বাইজেনটাইন, অটোম্যান ও ব্রিটিশ শাসনসহ বিভিন্ন পর্যায় পাড়ি দেয় এই অঞ্চল।

১৫১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৭ ডিসেম্বর অবধি ইসরায়েল অটোমান বা তুর্কিদের শাসনকাল ছিল। ... তুর্কিদের রাজত্বকালে সুলতান সুলেমান নাকি হজরত মহম্মদের (স.) কাছ থেকে স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন যে জেরুজালেমের সুরক্ষা প্রয়োজন। তাই ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম-এর চারপাশ ঘিরে অত্যন্ত মজবুত এক নগরপ্রাকার গড়ানোর কাজ শুরু করেন সুলেমান।

শাসক বদলের সঙ্গে সঙ্গে ইহুদিদের ভাগ্যেও দুর্গতি ঘটতে থাকে। ফলে ওই সময়গুলোতে তারা আদি নিবাস ছেড়ে ইউরোপমুখী হয়। সেখানেও অশান্তি, একের পর এক প্রতিকূলতা হাজির হয় তাদের সামনে। বিশেষ করে জার্মানিতে; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে হিটলারের ইহুদি-নিধনযজ্ঞের বলি হয় তারা।

ইতিহাসের নতুন মোড় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিদের হাত থেকে ব্রিটিশদের হাতে চলে যায় ইসরাইল। ওই বছর ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। ফলে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্কো-ব্রিটিশ বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ভাগ হয়ে যায় দুই দেশের সীমানা। এতদিনের ভূমিহীন ইহুদিরা নতুন ভূমির স্বাদ পেয়েই শক্তিমত্তা প্রদর্শনে মত্ত হয়ে ওঠে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দেই হামলা চালায় ফিলিস্তিনি অংশে। তারপর থেকে সহিংসতা আর জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে দখল করে চলেছে ফিলিস্তিনি ভূমি।

এ তো গেলো জাতি ও ভূখণ্ডের অতীত। এবার দু-চার লাইন ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করবো। শিল্পের এই শাখায় দেশটির ইতিহাস ভালোই পুরনো। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে সৌদি আরবের রাজা ইবনে সৌদ-এর ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে মাধ্যমটিতে যাত্রা শুরু হয় তাদের। নির্মাতা ছিলেন ইব্রাহিম হাসান। পরবর্তী সময়ে আরো কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ হয়। কিন্তু অন্যান্য অনেক কিছুর মতো রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই ধারাবাহিকতা টেকেনি; এক প্রকার থেমেই যায়। দু-একটি যা নির্মাণ হতো, তাতেও আবার দলীয়করণের ব্যাপার-স্যাপার থাকতো।

দেশটিতে প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৮০-তে হয় আরেকটি। এর পর ১৬ বছরের বিরতিতে ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন-এর (পি এল ও) পৃষ্ঠপোষকতায় দেশটিতে নতুন করে চলচ্চিত্রের পথযাত্রা শুরু হয় ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে। এই সময়ে এসে ফাতাহ, ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (ডি এফ এল পি) এবং পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের (পি এফ এল পি) মতো ফিলিস্তিনি বিভিন্ন সংগঠন নিয়েও প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয়। এ রকম হাতেগোনা কয়েকটি তথ্যচিত্র নির্মাণ হলেও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র-নির্মাণে পিছিয়ে ছিলো দেশটি। প্যারাডাইস নাও দিয়ে হানি আবু আসাদের হাত ধরে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে নতুন করে চলচ্চিত্রযাত্রা শুরু হয় ফিলিস্তিনে। এরপর ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি নির্মাণ করেন ওমর।

আসাদের জন্ম ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর; ইসরাইল অধ্যুষিত নাজারাত-এ। চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি পেপার হাউস নামে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে, সেটা ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের কথা। এরপর তিনি একে একে নির্মাণ করেন দ্য ফোরটিন চিক (১৯৯৮), রানাস ওয়েডিং (২০০২), প্যারাডাইস নাও, কুরিয়ার (২০১২)। এছাড়াও তিনি বেশকিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এর মধ্যে প্যারাডাইস নাও বিদেশি ভাষায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে ‘গোল্ডেন গ্লোব’ পায়। ওমর ৮৬তম অস্কারে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনীত হয়। এছাড়া এটি ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘আন সার্টেন রিগার্ড’ (Un Certain Regard) বিভাগে জুরি পুরস্কার পায়। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা দরকার, নিজের কর্ম ও কর্মফলের ভিত্তিতে হয়তো আসাদকে একেকজন একেক ধারায় ফেলতে পারেন। তবে সাবেক এই বিমান প্রকৌশলী ‘নিজেকে রাজনৈতিক ধারার চলচ্চিত্র-নির্মাতা মনে করেন না। এবং প্যারাডাইস নাও নিয়ে ইহুদি ও বিভিন্ন ইসরায়েলি সংগঠন আন্দোলনের সময় আসাদ ঘোষণা দেন, তিনি পরিচালক হিসেবে নিজেকে ফিলিস্তিনি জাতির মুখপাত্র ভাবতে পছন্দ করেন না।’

৩.

ওমর নিয়ে কথা বলার সুবিধার্থে চলচ্চিত্রটির সংক্ষিপ্ত কাহিনি বলে নেওয়া দরকার। তিন বন্ধু¾ওমর, তারেক ও আমজাদ। তারেকের বোন নাদিয়াকে আমজাদ পছন্দ করলেও তার প্রেম ওমরের সঙ্গে। পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকা ভাগ হয়ে যখন দেয়াল হলো, নাদিয়া আর ওমরের বাড়ি আলাদা হয়ে দুই দেশে পড়লো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওমর দেয়াল টপকে প্রায়ই দেখা করে নাদিয়ার সঙ্গে। লোকচক্ষুর আড়ালে তাদের প্রেম গড়াতে থাকে। এর মধ্যে এই তিন বন্ধু দেশপ্রেম আর দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসরাইলি এক সেনাকে রাতের আঁধারে গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু ইসরাইলের শক্তিশালী গোয়েন্দা-বাহিনীর কাছে এ খবর ফাঁস হতে সময় লাগে না। অন্যতম সন্দেহভাজন হিসেবে ইসরাইলি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ওমর। তাদের মধ্যে কে বন্দুক চালিয়েছে¾সেই তথ্য পেতে তার ওপর মারধরসহ বিভিন্ন নির্যাতন চালায় ইসরাইলি গোয়েন্দারা। কিন্তু ব্যর্থ হয়। শেষমেষ ওমরকে তাদের গুপ্তচর হওয়ার প্রস্তাব দেয়। সঙ্গে এও জানায়, তাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে সে কোনোদিনই নাদিয়াকে পাবে না। এমন পরিস্থিতিতে রাজি হয়ে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ফিরে যায় ওমর।

শুরু হয় নতুন খেলা, ইসরাইলি কারাগার থেকে মুক্ত ওমরকে কেউ বিশ্বাস করে না। এমনকি নাদিয়াও। সবার চোখে আস্তে আস্তে দেশপ্রেমিক ওমর পরিণত হতে থাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয় তিন বন্ধুর মধ্যেও। আর এই ভুল বোঝাবুঝির বলি হয়ে মারা যায় তারেক। আর মাঝখান থেকে ওমর আর নাদিয়ার মধ্যে বিভেদ তৈরি করে আমজাদ এবং নাদিয়াকে সে বিয়েও করে।

দু-বছর পরের কথা। এক ফিলিস্তিনি কমান্ডারকে হত্যায় ওমরকে ব্যবহার করতে চায় ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা রামি। এক্ষেত্রে ওমরকে ভয় দেখায় রামি; কথা না শুনলে তারেকের মৃত্যুর রহস্য ফাঁস করে দেওয়া হবে। কিন্তু ততদিনে ওমরেরও বোঝাপড়া পরিষ্কার হয় যে, নাদিয়াকে হারানো থেকে শুরু করে বিশ্বাসঘাতক হওয়া, সবকিছুর জন্যই রামি দায়ী। তাই সে প্রস্তাবে রাজি হয়ে রামি’র সামনে যায়। আর সামান্য অভিনয় করে শেষমেষ হত্যা করে ষড়যন্ত্রকারী রামিকেই।

৪.

সত্যি বলতে কি, ওমর নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যা পেয়েছি, তা দুই ধরনের। এক দৃষ্টিভঙ্গিতে চলচ্চিত্রটির পরিচালক ভালোই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আরেকদিক থেকে বলা যায়, হানি আবু আসাদের নিখুঁত খণ্ডিত বাস্তবতার চিত্রায়ণে অনেক সামগ্রিক বাস্তবতা অগোচরেই রয়ে গেছে। প্রথমে মুন্সিয়ানার দিকগুলোই বলি।

ক.

প্রতিদিন দড়ি বেয়ে দেয়াল টপকে ওপারে যায় ওমর। ভালোবাসার মানুষ নাদিয়ার সঙ্গে দেখা করে সে। এই দিক থেকে এবং তাদের শেষ পরিণতির বিচারে অনেকেই ওমরকে তুলনা করেন রোমিও-জুলিয়েটের কাহিনির সঙ্গে। কিন্তু আসাদ নিজেকে যে ঘরানার পরিচালকই দাবি করুক না কেনো, এই চলচ্চিত্রে তার ক্যামেরা তারেকদের ঘরের দরজায় নাদিয়া-ওমরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা দেখানোর জন্য যতোটা সময় ব্যয় করেছে, তার চেয়েও বেশি করেছে তিন বন্ধুর স্বপ্নের পিছনে। এছাড়া শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায়, ‘স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এবং সে স্বপ্নের প্রতিবন্ধকতা প্রতিটি চরিত্রকে কীভাবে প্রভাবিত করে। এই চলচ্চিত্রে কোনো ঘটনাই দেশপ্রেম থেকে আলাদা হয়ে ব্যক্তিগত হয়ে ওঠেনি; বরং ব্যক্তিগত অনেক কিছুই দেশপ্রেমের কারণে করুণ পরিণতির দিকে চলে গেছে। নইলে ওমর ইসরাইলি গুপ্তচর হলে নাদিয়ার কী সমস্যা? একান্ত স্বার্থগত চিন্তার জায়গা থেকে দেখলে, ওমরকে পেলেই সে সুখী হওয়ার কথা। কিন্তু সে গুপ্তচর ওমরকে চায় না, চায় দেশপ্রেমিক ওমরকে। একই ধরনের বিচার ওমরের জায়গা থেকেও করা যায়; ইসরাইলি গোয়েন্দাদের কাছে আমজাদের নাম বলে দিলে কোনো সমস্যাই হতো না তার। কিন্তু সে তা করে না।

খ.

ফিলিস্তিনিদের জীবনে ইসরাইলিদের নজরদারি কতোদূর পর্যন্ত প্রোথিত, তা তুলে আনার ক্ষেত্রে ভালো নম্বর পাবেন পরিচালক। গণমাধ্যমের খবরে দেখি, ফিলিস্তিনিরা কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে সেটির প্রতিশোধ তুলতে খুব একটা সময় নেয় না ইসরাইলিরা। তাদের কোনো স্থাপনায় ফিলিস্তিনের কোনো অজ্ঞাত বালক একটা ইট ছুড়লেও তার চৌদ্দগোষ্ঠীকে খুঁজে বের করতে দু-এক দিনের বেশি সময় লাগে না। আর এটি সম্ভব হয় গুপ্তচরের কারণে। আর এ গুপ্তচরবৃত্তিতে রাজি না হলে ভয়ভীতিসহ ‘নানান কথা’ ফাঁস করার হুমকি দেওয়া হয়। আবার এসবও তারা পায় অন্য গুপ্তচরের মাধ্যমে। ওমর-এ সেই দৃষ্টান্তই দেখা যায়। নইলে ওমর নাদিয়াকে চিঠিতে কী লেখে, তা রামির মুখস্থ থাকে কীভাবে?

গ.

ইসরাইল-ফিলিস্তিনের ইতিহাস কিংবা বিরোধ আলোচনা করতে গেলে ধর্মের আবির্ভাব ঠেকানো যাবে না। কারণ, এখানে হিংসার হিসাব-নিকাশটা জাতিবিদ্বেষের। কিন্তু আজ ফিলিস্তিনিরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে সেখানে কেবল ধর্মপ্রেমই তাদের একমাত্র উপাস্য নয়। এ কথা কেউ বলতে পারবে না যে, সেখানকার মুসলমানরা ইসলাম ইসলাম বলে গলা ফাটায়। বরং পশ্চিমা গণমাধ্যমেও তাদের কণ্ঠে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের চিৎকার শুনি। আর এদিক দিয়ে ওমর ধর্মের জায়গা থেকে দেশপ্রেমকে আলাদা করে দেখাতে পেরেছে। এই চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র ওমর ‘এ যুগের ছেলে’। যে বিয়ের পর নাদিয়াকে নিয়ে হানিমুনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে; মৃত্যুর পর হুর-পরির স্বপ্ন নয়। একই কথা বলা চলে তারেক ও আমজাদকে নিয়েও। চলচ্চিত্রজুড়ে কোথাও দেশপ্রেমের সঙ্গে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলেননি নির্মাতা হানি আবু আসাদ।

৫.

সামগ্রিক বাস্তবতার অনুপস্থিতির কথা বলছিলাম। হানি আবু আসাদ বেশিরভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রেই থাকেন। যাই হোক, ফিলিস্তিনিদের এ দুর্দশার জন্য কেবল ইহুদিরা একাই দায়ী নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই ভূখণ্ডে তাদের ফিরে আসার সময় থেকেই পশ্চিমাদের সহযোগিতা শুরু। এ কথা প্রমাণ করে বলার দরকার নেই, যুক্তরাষ্ট্র এখন ইসরাইলের সবচেয়ে বড়ো মিত্র। তবে এক্ষেত্রে মিত্রদের যে স্বার্থগত কারণ আছে, তাও পরিষ্কার। তারা মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজে কৌশলে ইহুদিদের ব্যবহার করে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য

রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মহাদেশের প্রবেশদ্বার। গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল যদি সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রধান তিনটি মহাদেশের ওপর কর্তৃত্ব করা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য সহজ হয়।

সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে আফগানিস্তানের প্রসঙ্গ আনা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে এই দেশটি পুঁজির বিস্তার আর মুনাফা লাভের ক্ষেত্র হিসেবে সাম্রাজ্যবাদীদের অন্যতম খেলার মাঠগুলোর একটি। তারা কখনোই চায় না, সেখানে যুদ্ধ শেষ হোক। একইভাবে চায় না, ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগুলোর বিরোধ মিটে যাক।

হামাস ও ফাতাহর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে নয়, ইসরায়েলের প্রতি সম্পর্কের প্রশ্নেও। ... তাদের মূল লক্ষ্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নয়, ফাতাহর চলতি নেতৃত্বকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। অন্যদিকে, হামাস সব ধরনের আপসের বিরোধী। সেটাই তাদের প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার। ... একটা যুদ্ধ বাধলে গাজাবাসীর কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিকভাবে নিজের অবস্থা দৃঢ়তর করা সম্ভব হবে, সেই যুক্তিতে এই যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা।

এসব জায়গা থেকে ওমর অনেকটা বাস্তবতার খণ্ডিত উপস্থাপন হয়ে গেছে। পুরো চলচ্চিত্র দেখে মনে হয়েছে, এক ইসরাইলিরাই মনে হয় সবকিছুর জন্য দায়ী। অন্য কোনো দেশের হাত নেই। এক্ষেত্রে আসাদের বোঝাপড়াটা কেবল ইসরাইলকেন্দ্রিক মনে হয়েছে। তার ভাষ্য, ‘ইসরায়েলিরা যেদিন বুঝবে ফিলিস্তিনিদেরও আছে সমান অধিকার¾সমস্যার সেদিন সমাধান হবে।’ কিন্তু কেবল ইসরাইলিরা বুঝলেই কি হবে? 

৬.

বার্লিনের প্রাচীর সম্পূর্ণভাবে ভাঙা হয় ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৩ অক্টোবর। ঐতিহাসিক ওই মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। সেই অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন,

বার্লিনের ভাঙা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমার বার বার একটাই প্রশ্ন মনে হচ্ছিল, এত কষ্ট করে যে দেওয়াল ভাঙা হচ্ছে, সেই কঠিন, হিংস্র দেওয়াল আদৌ কেন গাঁথা হয়েছিল? ... যারা দেওয়াল গেঁথেছিল, তারা কি জানত না, কঠোর নিষেধ মানুষ বেশি করে ভাঙতে চায়। ... দেওয়াল গাঁথার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিশ্চিত মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষ, যাঁরা নেতৃত্ব পদের অধিকারী, দেশের আপামর জনসাধারণের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন তাঁরা বোধ করেননি। ... সব দেওয়ালেরই কোথাও না কোথাও একটা ছিদ্র থাকে। সেই ছিদ্র ক্রমশ বড় হয়।

সুনীলের কথা ঠিক। কারণ পশ্চিমতীরের ওই দেয়ালেও এরই মধ্যে ছিদ্র তৈরি হয়েছে। কারণ গত ৮ নভেম্বর ওই ‘সুউচ্চ দেয়ালের একটি ছোট্ট অংশ হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে ফেলে ফিলিস্তিনি তরুণরা। সেই ফাঁক দিয়ে উড়িয়ে দেয় ফিলিস্তিনের পতাকা।’

ওমরকে দিয়ে ওমর-এর শেষ দৃশ্যে হানিও হয়তো সুনীল কিংবা ফিলিস্তিনি তরুণদের মতো সম্ভাবনার একটা ছিদ্র এঁকে গেছেন। কারণ দেয়ালের ৫-১০টা ইট ভাঙ্গার মতো হয়তো এক রামির মৃত্যু ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার জন্য নিতান্তই তুচ্ছ। কিন্তু যুদ্ধটা তো চলতে থাকলো, তাই না? হানির শেষ প্রশ্নটা এ রকমই মনে হয়েছে।

 

লেখক : মইনুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং আসাদ লাবলু, দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত

neo.moynul@gmail.com

asadmcru@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. ঘোষ, ঋতুপর্ণ (২০১৩ : ৪৮৩); ফাস্ট পার্সন ২; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

২. https://tinyurl.com/4dk59hzc

৩. এনায়েতুল্লাহ, মুফতি; ‘ফিলিস্তিনকে ভুলে গেছে আরব নেতৃত্ব!’; সমকাল, ২৫ জুলাই ২০১৪।

৪. ফেরদৌস, হাসান; ‘ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান হয় না কেন?’; প্রথম আলো, ১৯ আগস্ট ২০১৪।

৫. ‘‘ওমর’ ভালোবাসার গল্প তবে ...’; কালের কণ্ঠ, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।

৬. গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল (১৪১৬ বঙ্গাব্দ : ৫); ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ; আনন্দ পাবলিকেশন, কলকাতা।

৭. ‘এমন বৈষম্যের দেয়াল আছে ফিলিস্তিনেও’; কালের কণ্ঠ, ১০ নভেম্বর ২০১৪।




বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন